আমার কিছু কথা
এটুকু শুধু মনে পড়ে, আত্মপ্রকাশের একটা প্রবল আবেগ প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম কবিতার দু’টি চরণ যখন ইচ্ছার অজাšে—ই অগোছালোভাবে কাগজের বুকে লিপিবদ্ধ করেছি। সময়টা ঠিক মনে নেই। সেটা হয়তো কৈশোর ও যৌবনের সন্ধি¶ণ হবে। ফুল ও ফসলের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা নানা বর্ণে নানা রূপে জীবনের ঋতু পরিবর্তনের এক অপূর্ব মুহূর্তে যখন প্রবেশ করেছে- ঠিক তখন এক মোহনীয় আলোকবর্তিকা শাšি—মন্ত্রধ্বনি হয়ে আমার হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলো। সে ছিলো আমার কবিতা- আমার হৃদয়ের রানী, আমার সাধনার আরাধ্য প্রেমিকা। আজ জীবনের সামনে যখন সায়াহ্নছায়া অপে¶া করছে তখন মনে হয় যাকে আমি ইচ্ছার অজাšে—ই অবলীলায় পেয়েছিলাম তাকে যেনো লালন করেছি অবহেলায়। আজ মনে হয় জীবিকার জন্য যদি সৈনিক জীবন বেছে না নিতাম- ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা যতোই দেখা দিক না কেনো, যদি রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ না করতাম অথবা অনিবার্য কারণে রাজনীতির জটাজালে পা দু’টোকে জড়িয়ে না ফেলতাম, তাহলে হয়তো অলৌকিকভাবে যে আনন্দের ভার আমার ওপর অর্পিত হয়েছিলো তাকে আঁকড়ে ধরেই আত্মপ্রকাশের প্রবল আকাক্স¶াকে সফল করতে পারতাম।
মানুষ অনায়াসে যা পায় তার অধিকাংশই অবহেলায় হারিয়ে ফেলে। আমার জীবনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কাব্যকে আমি যথাযথ আদরে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। তারপর আবার সে কবিতা যখন তন্দ্রাতুর চোখে ¯^প্নের রানী হয়ে বিচরণ করতে চেয়েছে তখন কোনো এক কালো ব্যাধের শরাঘাতে সে আহত হয়েছে। আমি তাকে উদ্ধার করতে পারিনি, কারণ তখন আমি বন্দি। আমার চারিদিকে উচ্চ প্রাচীর- লোহার গরাদ। একটুকরো কাগজ আর একটা কলমের জন্য আমার কবিতা শরবিদ্ধ কপোতের মতো কাতরাতো। আমি অসহায়ভাবে তখন জীবনমন্থন বিষ আকণ্ঠ পান করে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আর কবিতাকে শুধু সাš—¡নাসুধায় সিক্ত করে মনের মাঝে লুকিয়ে রেখেছি। তারই কিছু প্রকাশ এই “কারাগারে নিঃসঙ্গ দিনগুলো”।
এখানে আমার জীবনের কর“ণ অভিজ্ঞতাগুলো নতুন ¯^াদের উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে আছে। এখানে নির্জনের ব্যথাগুলো নতুন ছন্দে যে বুনুনির কাজ করেছি তা আগে কখনও করতে পারিনি। কারাগারের আহত কবিতাগুলোকে আমি নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করেছি। নতুনত্বের মধ্যে অসীমত্ব আছে। আমার জীবনের সে দুঃসহ দীর্ঘ সময়ের নির্জন-¯^জনের নিত্য সঙ্গমের মধ্যে শুধু কবিতার কথাই ভাবতাম। এই কবিতা আমার হৃদয়ের অরণ্যে তীরবিদ্ধ হরিণের মতো যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ছটফট করেছে। আমার হাত ছিলো অদৃশ্য শেকলে বাঁধা। আমি কবিতাকে সাজাতে পারিনি কলমের তুলি দিয়ে। অথচ কতো কবিতা তখন মুক্তির জন্য আর্তচিৎকার করেছে। আমি সে কবিতাগুলোকে মুক্ত করতে পারিনি। আমার হাতে কলম ছিলো না, কাগজ ছিলো না। এমনভাবে কেটে গেছে ছ’ছটা বছর। ছ’টা বসš—, ছ’টা হেমš— শরৎ শীত বর্ষা গ্রীষ্ম কখন কিভাবে কেটেছে অনুভবের সুযোগও আসেনি। ছ’টা ঈদের আনন্দ কেমন ছিলো জানিনি- বুঝিনি।
তারপর ফিরে এলো মুক্তির এক মাহেন্দ্র¶ণ। কারাপ্রাচীর থেকে বেরিয়ে এলাম মুক্ত বাতাসে। আহত কবিতাগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। কিছু পেলাম- কিছু পাইনি। যা পেয়েছি তা নিয়েই সাজালাম এই কাব্য “কারাগারে নিঃসঙ্গ দিনগুলো।” মুক্তির পর কারাগারের স্মৃতি নিয়ে লেখা সবগুলো কবিতা এই কাব্যে সংকলন করেছি। এখানে আছে আমার কারা-স্মৃতির সবগুলো কবিতা।
কাব্যের জগতে আমি শুধুই একজন কবিতা-প্রেমিক। এখানে আর কোনো সত্তার ঠাঁই নেই। আমার একটি রাজনৈতিক সত্তা রয়েছে। কিন্তু কাব্যের মাঝে আমি রাজনৈতিক সত্তাকে বিন্দুমাত্র ঠাঁই দেইনি। কবিতা কখনো দেশ-কাল-পাত্র-মত-আদর্শের গÊিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। কবিতা সার্বজনীন- কবিতার ব্যাপ্তি বিশ্বময়। আমার অš—রের একাš— সাধনার সম্পদের ওপর আমি রাজনীতির পরশ লাগাইনি। রাজনৈতিক কারণে আমি কারার“দ্ধ হলেও আমার সব কবিতাকে সাজিয়েছি কাব্যের মহিমায়।
আজ আমি পরম আনন্দের অনুভূতিতে দিশেহারা হয়ে উঠেছি। কারণ আমার জেল-জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতিগুলো গোলাপের মতো ফুটবে বইয়ের পাতায়। এটি আমার ৯ম কাব্যগ্রন্থ হলেও এখানে আছে আমার সবচেয়ে গভীর ভালোবাসা। এখানে আছে আমার হৃদয়ের রক্ত¶রণের কাহিনী- যা আজ প্রকাশিত হবে সর্বসম্মুখে। প্রমাণিত হবে, কবিরা কখনো পরাজিত হয় না- কবিতা কখনো ¯—ব্ধ থাকে না- কবিকে কখনো বন্দি রাখা যায় না।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
0 comments:
Post a Comment
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.